সাঁওতাল জাতীর লোকউৎসব করম পূজা

 সাঁওতাল জাতীর লোকউৎসব করম পূজা


আধুনিক সভ্য সমাজে যা উৎসব বলে গণ্য আদিম বা প্রাকৃতজনদের কাছে তা লোক উৎসব বলেই পরিচিত। লোক উৎসব তাই লোককেন্দ্রিক জীবন ধারার বা লোকজীবনের অনুগত সমবেত উল্লাস মুখরিত উৎসব।

  

সাঁওতাল জাতীর লোকউৎসব করম পূজা

আদিবাসী তথা সাঁওতাল সমাজের বিভিন্ন পরব-পালির (লোক-উৎসব) মধ্যে একটি জনপ্রিয় উৎসব বা লোকাচার হল কারাম (করম)। সাধারণত ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের পার্শ্ব একাদশীতে এই উৎসব পালিত হয়ে থাকে। তবে কারাম-এর প্রকার ভেদে কেউ কেউ অগ্রহায়ন মাসের পূর্ণিমাতে আবার অনেকে মাঘ মাসেও উদ্যাপিত করে।

কারাম মূলত সমৃদ্ধশীলতার পুজো। গ্রামের সকল পরিবারের যাতে ঐশ্বর্য বৃদ্ধি পায় তার সফলতার জন্য মহা সমারোহে অনুষ্ঠান করা হয়। এই উৎসব সাঁওতাল জাতির মধ্যে বেশী অনুষ্ঠিত হয়। তবে ছোটনাগপুরের পার্বত্য অঞ্চলের কৃষিজীবি ওরাঁও, মুন্ডা থেকে শুরু করে মানভূম, সিংভূম, বাঁকুড়া, মেদনীপুর জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের মাহাত (কুড়মি), ভূমিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্যাপিত হয়ে থাকে।

কারাম অনেক প্রকারের হয়। যেমন- মাঝি কারাম, ডৗঙ্গুয়া কারাম, গুরু কারাম, চেলা কারাম, মরা কারাম। এছাড়াও কারো বাড়ির ছাদে কারাম গাছ জন্মালে কারাম দেবতার আবির্ভাব মনে করা হয়। তখন ওই বাড়িতে কারাম পুজোর আয়োজন করার ধুম পড়ে যায়। লোকজন ডেকে নাচ-গান হয়। মেয়েরাই সব আয়োজন করে। বাড়ির সীমানার মধ্যে পুজোর আয়োজন করা হয়।

মাঝি কারাম :- মাঝি অর্থাৎ গ্রাম প্রধান এই কারাম পুজোর আয়োজন করে থাকেন। সেইজন্য এই কারাম বেশি জনপ্রিয় এবং সার্বজনীন। এই কারাম পুজোতে জাতি নির্বিশেষে সবাই একাত্ম হয়ে যায়। এই কারামকে ‘জাওয়া কারাম’ আখ্যা দেওয়া হয়। প্রতি বৎসর মহা ধুমধামে এর

আয়োজন করা হয়ে থাকে।

ভৗঙ্গুয়া কারাম:- ডাঙ্গুয়ী মানে অবিবাহিত। যখন গ্রামের ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে বিয়ের উপযুক্ত হয় তখন তাদের উদ্দেশ্যে ডাঙ্গুয়া কারাম অনুষ্ঠিত হয় । পাঁচ বৎসর অন্তর একবার এই কারাম অনুষ্ঠিত হয়। এই কারাম পালনের কোন বাধ্যবাধকতা নেই। বর্তমানে এর প্রচলন খুব একটা নজরে পড়ে না।

গুরু কারাম :- শিষ্যরা গুরুর কাছে বিদ্যাশিক্ষা আরম্ভ করার পূর্বে এই কারাম অনুষ্ঠিত হয়।

চেলা কারাম :- গুরুর কাছে বিদ্যাশিক্ষা শেষ হয়ে গেলে চেলা কারাম অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমানে গুরু কারাম ও চেলা কারাম প্রায় উঠেই গেছে।

মরা কারাম :- কোন ব্যাক্তির মৃত্যু হলে তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই কারাম অনুষ্ঠিত হয়। যার বাড়ির ব্যক্তি মারা যাবে তাকেই যে এই পুজোর ব্যবস্থা করতে হবে এরকম কোন বাধ্যবাধকতা নেই। মৃত ব্যক্তি যদি কারাম শুরু হয় কিংবা ধনি পরিবারের হয় তবেই এই কারাম উদ্যাপিত হয়।

গ্রামের সর্বময় কর্তা হলেন মাঝি। সমস্ত বিচারালয়ের শেষ স্তর যেমন

সুপ্রিম কোর্ট। সাঁওতাল সমাজে তেমনি মাঝি হলেন গ্রামের সর্বোচ্চ আদালত। তিনি আবার পুজো-পার্বণের হর্তাকর্তা। বিয়ে, শ্রাদ্ধ-শান্তি সমস্ত কাজই মাঝি দ্বারা পরিচালিত হয়। নায়কে বা পূজারীর ভূমিকা মাঝিকেই নিতে হয় ৷

সুতরাং গ্রাম প্রধান দ্বারা পরিচালিত ‘মাঝি কারাম’ বেশি প্রচলিত এবং সার্বজনীন। ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের পার্শ্ব একাদশীর দিনে কারাম অনুষ্ঠিতহলেও তার প্রস্তুতি চলে পঞ্চমী তিথি থেকে। সাধারণত কুমারী মেয়েরাই এই পুজো করে থাকে। পঞ্চমী তিথিতে তারা দল বেঁধে কোন নদী বা ঝরণার ধারে যায়। তাদের হাতে থাকে ছোট ছোট কাঠি এবং ডালা বা টুপা। সঙ্গে নেয় তিল, কলাই, মুগ, অড়হর, কুথি, ধানের বীজ ইত্যাদি। নদীতে স্নানের সময় ভেজা বালি সংগ্রহ করে ডালাতে জমা করে রাখে। তারপর ওই বীজগুলো ভেজা বালির উপর ছড়িয়ে হলুদ বাটার জল ছিটিয়ে দেওয়া হয়। সুন্দর একটি কচি ধান গাছের চারা তুলে ডালায় মধ্যিখানে রোপন করা হয়। একেই জাওয়া বলে। উল্লেখ্য, জাওয়া তুলতে যাওয়ার আগে গান গায়। গানটি এরকম।

কোথায় পালি রে বহিন ডালা কিরিঞ মাচি দ

কোথায় পালিরে বহিন ডালা কিরিঞ বীজ!

লায়া ঘরে পালি ভাইয়া ডালা কিরিঞ মাচি দ

মাঝি ঘরে পালি ভায়া জাওয়া কিরিঞ বীজ।

ডালা রাখা হয় মাচি বা চৌকির উপর। ভাই বোনকে জিজ্ঞেস করেছে। চৌকি কোথায় পেলে? – বোন উত্তর দিচ্ছে, লায়া ঘরে ডালা রাখার মাচি পেলাম এবং মাঝি ঘরে বীজ পেলাম। অর্থাৎ মাঝির অনুমতি নিয়ে সমস্ত কিছু হচ্ছে।

জাওয়া তোলা হয়ে গেলে স্নান সেরে গান গেয়ে বাড়ি ফেরে। জাওয়া সাধারণত মাঝির বাড়িতেই রাখা হয়। তার আগে গান এবং নাচের মাধ্যমে জাওয়া জাগানো হয়।এসব গানের মধ্যে আছে ফসল দেবতা বা করম ঠাকুর বন্দনা, স্তুতি পাঠ ইত্যাদি। এ সময় বাজনার কোন দরকার হয় না, গানের তালেই মেয়েরা কোমর দুলিয়ে আগে পিছে নাচে। গান সাধারণতঃ আঞ্চলিক বাংলা, সাঁওতালী এবং হিন্দি ভাষার সংমিশ্রণে গাওয়া হয়। যেমন –

জাওয়া লুমৗং জাওয়া – কিয়ৗ কিয়ৗ জাওয়া…… (২)

জাওয়া লুমৗং ধান বাহুলা

সে হয়ে ধান – একপাতে শায় পাত ……(2) 

রাড় হরিনাম জিরিহির পাণি। ……. (2)

এভাবে যতগুলো বীজ-এর কথা মনে পড়ে বা জাওয়াতে মেশানো আছে তার নাম উল্লেখ করে জাওয়া গান মেয়েরা করে। জাওয়া জাগানোর অর্থ হল হিন্দুদের যেমন সন্ধেবেলায় তুলসিতলায় প্রদীপ জ্বালানো হয় ঠিক সেই রকম সকাল-সন্ধ্যায় জাওয়া বন্দনা গীতের মাধ্যমে করা হয়।

পাঁচদিন ধরে জাওয়া জাগানোর সময় বীজগুলোতে জল দেওয়ার ফলে অঙ্কুর বার হয়। জাওয়া যেদিন থেকে তৈরি করা হয় সেদিন থেকে অংশগ্রহনকারী মেয়েদের ব্রত শুরু হয়ে যায়। মেয়েরা খাট বা চৌকিতে বসে না। জাওয়া যে কজন মেয়েরা মিলে পোতে তাদের কাঠি দিয়ে ভাগ করা থাকে কেউ নিয়ম ভঙ্গ করলে তার প্রভাব নির্দিষ্ট জাওয়ার উপর পড়ে। কেউ মাছ মাংস খেলে তার জাওয়ার উপর মাছি বসবে। মাটিতে পায়খানা করা নিষিদ্ধ। পায়খানা করতে হবে পাথরের উপর। কেউ মাটিতে পায়খানা করলে জাওয়ার গোড়ায় মাটি উঠে গিয়ে নষ্ট হয়। চুলকানি লাগলে কাঠিতে চুলকাতে হয়। তেল, চিরুণি ব্যবহার করা চলবে না। নুন, ঝাল নিষিদ্ধ। আগুনের কাছে যাওয়া নিষিদ্ধ। এভাবে পাঁচদিন ধরে চলে ব্রত উদযাপন। চতুর্থ দিনের রাত্রিকে ‘সংজক’ বলা হয়। এদিন সারারাত ধরে মেয়েরা জাওয়া বন্দনা করে। পাঁচ দিনের দিন খুব ভোরে মেয়েরা দল বেঁধে শালুক ফুল তুলতে যায় পুকুরে। সঙ্গে থাকে অবিবাহিত অল্পবয়স্ক দু-একজন ছেলে। মেয়েদের জন্য শালুক ফুল পুকুর থেকে তুলতে সাহায্য করে। ওই ফুল থেকে জাওয়া এবং করমতলা সাজানো হয় ।

পাঁচ দিনের দিন মেয়েদের ব্রত শেষ হয়ে যায়। পরের দিন সকালবেলায় তেল, সাবান দিয়ে স্নান করে নেয়। নতুন কাপড়ে নিজের দেহকে সাজিয়ে তোলে এবং দল বেঁধে গাইতে গাইতে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে জাওয়া জাগাতে যায়। সেখানে গিয়ে গান গায় এবং নাচে। গান প্রায় একই রকম। সেই বন্দনা গীত, 

‘জাওয়া লুমৗং জাওয়া কিয়ৗ কিয়ৗ জাওয়া” থেকে শুরু।

এরপর একাদশীর দিন শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান। অন্য গ্রাম থেকে জাওয়া জেগে ফিরে আসার পর সন্ধ্যে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের যুবতী মেয়েরা দল বেঁধে মাথায় বেতের ডালা বা টুপা নিয়ে চলে ধান ক্ষেত থেকে ধানের শীষ সংগ্রহ করতে। ক্ষেত অবশ্য তাদের আগেই ঠিক করা থাকে। ক্ষেতের পাশাপাশি আগে দেখে রাখে। মেয়ের দল গান গাইতে গাইতে যায়। হাঁটু সমান ক্ষেতের জলে নেমে ধানের ছোট ছোট গাছের মাঝখানে গিয়ে লাইন করে দাঁড়ায়। হাতে ধরা থাকে ডালা।

মুহূর্তের মধ্যে বিড়বিড় উচ্চারণ করে ছোটাছুটি করে ধানের শীষ সংগ্রহ করে। ঠিক একইভাবে ফিরে আসে একই জায়গায়। শীষ ভর্তি ডালা নিয়ে তারা পুকুর পাড়ে আসে। ওখানে উঁচু ঢিবির মতো করে একটা বেদি তৈরি করা থাকে। সেখানে ডালগুলো গোল করে রেখে স্নান সেরে নেয়। তারপর ফুল পাতা ভাসিয়ে দিয়ে পুকুর বন্দনা করে। বন্দনার শেষে মাথায় ডালা নিয়ে যে যার বাড়িতে ফেরে।

অপরদিকে গ্রাম প্রধান (মাঝি) বা পুরোহিতের বাড়িতে ধুম পড়ে যায়। মেয়েদের দল সোজা চলে আসে গ্রাম প্রধান বা পুরোহিতের বাড়ি। পুরোহিতকে পুজোর সামগ্রী জোগাড় করা থেকে সমস্ত অনুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে সাহায্য করে। মেয়েরা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে এটা-ওটা জোগাড় করতে। জাওয়া নারী সমাজের অঙ্গ হলেও পার্শ্ব একাদশীরে দিনে সন্ধে বেলায় ‘করম ঠাকুর-কে মাঝি আখড়ায় আনার জন্য নারী, পুরুষ সকলেই ধামসা মাদলের তালে গান করতে করতে মাঝি বা পুরোহিতকে নিয়ে যায়। পুরোহিতের ডান হাতে ধরা থাকে এক ঘটি জল এবং বাঁ হাতে ধরা থাকে একটু নতুন কুলো। তার মধ্যে থেকে গোবর, ধূপ, ধুনো, সুতো, সিঁদুর, দুর্বাঘাস, কাজল, ভেলাজার ফল, একখন্ড বস্ত্র, ডাল কাটার অস্ত্র (তাবলা বা কুঠার) এবং বাটিতে সামান্য তাংহান্ডি বা (মাদক দ্রব্যের রস)। করম ঠাকুরকে মাঝি আখড়ায় আনার জন্য যে প্রস্তুতি গান হয় তা নিম্নরূপ।

তাঁহা রেতা নানা তারনা, তাঁহা রেতা নানা হো

তাঁহা রেতা নানা তারনা,না নানা হো

সাজো সাজো নায়কে বাবা, দিয়ৗ সাজো নায়কে বাবা 

দিয়ৗ জো বারায়েতে, দিয়ৗ জো সাজায় দেহো রে।। 

সাজো সাজো আয়ো মোরা, সুপা সাজো আয়ো মোরা। 

সাজো সাজো আয়ো মোরা, ধুতিকেরা ঘাঁস সাজায় দেহো।

দেগো য়ায়ো সাজায় দেহো রে।

অর্থাৎ পুরোহিত ঠাকুর তুমি সাজো, প্রদীপ জ্বালাও । মা গো (পুরোহিতের স্ত্রী) তুমি সাজো, কুলো সাজিয়ে দাও। প্রদীপ বার করে কুলোতে সাজিয়ে দাও, দুর্বাঘাস সাজিয়ে দাও। মা গো তুমি সাজিয়ে দাও।

সাজো সাজো য়ায়ো মোরা, রাইমুনি ধানা

সাজো সাজো আয়ো মেরা, ধুবিকেরা ঘাঁসা জো

দেগো যায়ো সাজায় দেহোরে, দেহো যায়ো সাজোয় দেহো রে।

সাজো সাজো আয়ো মোরা, ধুবিকেরা ঘাঁসা জো

সাজো সাজো আয়ো ভেলাওঞ্জা সাজো

দেহো যায়ো সাজায় দেহো রে, দেহো আয়া সাজায় দেহো রে।

অর্থাৎ মা গো তুমি রাইমনি ধান সাজিয়ে দাও, দুর্বাঘাস, ভেলাঞ্জার ফল

সাজিয়ে দাও ইত্যাদি। এভাবে নায়কে বাবার কুলোর ডালাতে প্রদীপ, দুর্বাঘাস,সনেকেরি খাঁড়া, ঘটির জল, “গুরিচ ডুবুঃ” (খানিকটা গোবরের ঢেলা) নিয়ে করম ঠাকুরকে মাঝি আখড়ায় আনার উদ্দেশ্যে প্রস্তুতি নেয়। তখন যে গান গাওয়া হয় তা

নিম্নরূপ :—

উঠ সেহো গাঁয়ের মোড়ল, চলো সেহো দশে পাঁচে

চলো যাবো করমে আনিজে বানিজ।

চলো সেহো দশে পাঁচে, হামারিয়া সঙ্গে হো

সবাই মিলিমিশি করমেকা ডার কাটি আনিবো।

উল্লেখ্য,করম ঠাকুর কোন মূর্তি বা শিলাখন্ড নয়। লোকালয় থেকে খানিকটা দূরে একটা করম গাছ। গাছটার মাথার দিকের ডাল থাকবে দু-মাথা রাস্তার মতো।

এদিকে বাজনাদারদের বাজনা শুরু। মাদলের চড়াং নিম্নরূপ:-

ধাতিঞ হেতাং হেতাং হেতাং তিঞ তিঞ

ধানিঞ হেতাং হেতাং হেতাং কুটবুর

(শুরু) – হেতাং জাঁড়ব, হেতাং জাঁডব-

মাদল এবং ধামসার দ্রিমি দ্রিমি তালে বাজনা বেজে চলে। নায়কে বেরোলেন বাড়ি থেকে। পেছনে গ্রামবাসী। মেয়েরা গান গায—

তাঁর রেতা নানা তারানা তাঁহা রেতা নানা হো

তাঁহা রেতা নানা তারনা না নানা হো

তকয় রেয়াঃ কারাম দ-

সিলি লেকান কারাম দ- (তকয়-কাদের)

তকয় রেয়া কারাম দ-

পাণডারি ফুল।

মাঝি বাবা কারাম দ

সিলি লেকান কারাম দ

নায়কে বাবা কারাম দ

পাণডারি ফুল।

তকয় মেদয় চিয়া লেদা

সিলি লেকান কারাম দ

তকয় মেদয় চিয়ী লেদা

পাণডারি ফুল।

গুতি কড়ায় চিয়ী লেদা (গুতি কড়া-রাখাল পুরুষ)

সিলি লেকান কারাম দ

কাড়মি কুড়িয় আগুলেদা [(কাড়মি কুড়ি-রাখাল মেয়ে)]

পাণডারি ফুল।

করম গান “তাঁহা রেতা” দিয়েই শুরু হয়। উল্লিখিত গানের মানে হল “কার কারাম এত সুন্দর গো, কার পাণডারি ফুলের এতো সৌন্দর্য। কে দেখেছিল এত সুন্দর করম গো, কে দেখে রেখেছিল পাণডারি ফুল? রাখাল ছেলে দেখে ছিল এত সুন্দর কারাম গো, রাখাল মেয়ে এনেছিল পাণডারি ফুল”।

এভাবে বাজনার তালে তালে গান গেয়ে আগে থেকে নির্দিষ্ট করম গাছের তলায় সকলে উপস্থিত হয়। নায়কে অর্থাৎ পুরোহিত পুজো করতে বসেন। অন্যরা নায়কেকে ঘিরে বসে পড়ে। যারা গানে পারদর্শী তারা। ‘তাঁহা রেতা’ দিয়ে। গান শুরু করে। তারা নায়কের উদ্দেশ্যে গান গায়—

গাই কেরা গোবরা সামুদাকা পাণি 

গুরিজ মেসে নায়কে বাবা কারাম বুটী দ। 

অর্থাৎ, গোবরের ঢেলা এবং সমুদ্রের জল দিয়ে করম গাছের গোড়ায় মন্ডলী দাও নায়কে বাবা, নায়কে গান করে না কিন্তু তার প্রত্যুত্তরে গান হয় –

গাই কেরা ঘোবরা সামুদাকা পাণি

গুরিচ কেদাঞ হো মানওয়া কারাম বুটৗ দ।

পুনরায় গ্রামবাসীগণ গান গায় –

তলে মেসে নায়কে বাবা একা লাতি সুতৗম দ

তলে মেসে নায়কে বাবা কারাম বুটৗ দ।

এভাবে মেথি, সিন্দুর, কাজল, ঘি, দুধ যতগুলি পুজোর সামগ্রী মজুত আছে, তার নাম উল্লেখ করে পুজো অর্ঘ্য দেওয়ার সময় গান গাওয়া হয়। তারপর গানের মাধ্যমেই জিজ্ঞাসা করা হয় –

চেতে লৗগিৎ হো কারমুম হেচ আকানা হো

চেতে লৗগিৎ হো কারমুম সেটের আকানা ।

নাম লৗগিৎ হো কারমাঞ হেচ আকানা হো

নাম লৗগিৎ হো করমাঞ সেটেরাকানা।

কারমু তুমি কি জন্য এসেছ, কি জন্য হাজির হয়েছ ? কারমু আমি তোমার জন্যই এসেছি, তোমার জন্যই হাজির হয়েছি।

নায়কে ঘটির জলে নিজের পা ধোয় এবং কারাম গাছে জল ছিটিয়ে

দেয়। তখন আবার গান শুরু হয়—

না ছুওয়াই নায়কে বাবা, না ছুওয়াই নায়কে বাবা

আগে তো গড় ধোওয়াওলে, তবে বাবা পাণী ছিটাই দে।

জগমাঝি তুমি ছুঁয়োনা

আগে ‘গড়’ তেরি কর, তারপর জল ছিটাবে। গাছের গোড়ায় পূজা অর্ঘ্য সমাপ্ত হবার পর গান শুরু হয়—

তাঁহা রেতা নানা তারনা, তাঁহা রেতা নানা হো

তাঁহা রেতা নানা তারনা, না নানা হো।

দে কারমা দেলা কারমা, দে বেরেৎ মে কারমা

দে কারমা দেলা কারমা দে তেঙ্গোণ মে।

বৗঞ চালাঃ হো কৗরমু বৗঞ সেনঃ হো ককৗরমু

দো রুওয়ৗড় মে কৗরমু, দো চালাঃ মে। 

আম মায়াতে কারমা, আলো সেরেম হমরা

আম মায়াতে কারমা ইসি সেরমাঞ তিরৗস আকাদ ।

আলো সেয়েম রাগ কারমা, আলো সেয়েম হমরা

ইদিতে হোঞ ইদি মেয়ে, কলে রেগেঞ দহমেয়া হো।

দে কারমা হো কারমা, হেও মেয়াঞ হো কারমা

দে কারমা হো কারমা হবর মেয়াঞ হো কারমা 

তওয়া তে দঞ উম মেয়া, দাহে তে দঞ নাড়কা মেয়া হো।

এসব গানের অর্থ হলো করম ঠাকুর তুমি এতোদিন ছিলে না। গ্রাম

ছেড়ে পালিয়ে ছিলে। আজ আমরা তোমাকে পেয়েছি। গ্রামে নিয়ে যেতে এসেছি।চল, উঠে দাঁড়াও। এতদিন তোমার বহু কষ্ট হয়েছে। ঠিকমতো খাওয়া জোটে নি,পরনে কাপড় জোটেনি, চোখে কাজল জোটেনি। তোমার কষ্টতে আমরাও কষ্ট পাচ্ছি। আজ তোমাকে সব কিছু দিচ্ছি। তুমি আমাদের সঙ্গে এসো। তোমাকে কোলে বসাবো। দুধ দিয়ে স্নান করাবো। দই দিয়ে মাথা ধোওয়াব।

এরপর দুজন অবিবাহিত যুবককে করমডাল কাটার জন্য। নির্দেশ দেওয়া হয়। যে ডালে তিনটি শাখা বেরিয়েছে তা দেখে নিতে হয়। তার দুদিকের শাখা বাদ দিয়ে মাঝের শাখা ডালটি কেটে নেওয়া হয়। মাটিতে যেন ডাল না পড়ে তাও খেয়াল রাখতে হয়। সে সময়ের একটি গান হল – 

প্রবেশ পরিমাণ উত্তর দখিন

চৗর কুঁড় জো আছে হো (চৗর-চার) 

কোন্ কোনের ডৗর বাবা কাটিব (ডৗর-ডাল) 

কোন্ কোনের ডৗর বাবা কাটি আনিব।

পুরব পছিম উত্তর দখিন

চৗর কুঁড় জো আছে হো

উত্তর নাখা দুয়ো করম ডৗরাজো

কাটি আনাই দে।

তখন যুবক দুটি গাছে উঠে ডাল কেটে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে সবাই গাছের চারিদিকে ঘুরে ‘দুরুমজাঃ’ সুরে গান করে –

তাঁহা রেতা রে, না নানা রে

তাঁহা রেতা নানা তারানা, না-নানা রে। 

কারমা লো কারমা লো করম কাটি গেল

করম নাহি কাটি গেল, ছাই কাটি গেল।

করম ডাল কাটা পর্ব শেষ হলে পুনরায় মাঝি আখড়ার উদ্দেশ্যে ধামসা

মাদলের তালে নাচ করতে করতে ফেরা হয়। গান গাওয়া হয় –

তাঁহা রেতা নানা তারনা, তাঁহা রেতা নানা হো

তাঁহা রেতা নানা তারনা, না নানা হো।

য়ানো সে গো য়ামকি দেবী, সামুদাকা পাণী

য়ানো সে গো য়ামকি দেবী কাঁসাকেরা থালা জো

উরুনাকা বোনা কিরি, করমেকা ডৗর য়ানালাম

দেখো যায়ো গড় ধোওয়ায় দে।

অর্থাৎ ওগো অমকি দেবী (কোন স্ত্রী লোক) তুমি সমুদ্রের জল নিয়ে এসো, কাঁসার থালা নিয়ে এসো। উরুণ বন থেকে করম ডাল কেটে এনেছি, তুমি আদর আপ্যায়ন করে ‘গড়’ ধুইয়ে দাও।

এভাবে করম ডাল নিয়ে সকলে উপস্থিত হয় মাঝি আখড়ায়, যেখানে মাটি দিয়ে বেদি করা হয়েছে। একে বলা হয় করম থান। নায়কে নিজের হাতে করে করম ডালটি পুঁতে দেয়। করম ডাল পোঁতা হলে গান গাওয়া হয় –

তাহা রেতা নানা তারনা তাঁহা রেতা নানা হো 

তাঁহা রেতা নানা তারনা না-নানা হো। 

আনো আনো নায়কে বাবা একলাতি সুতৗ জো।

বাঁধায় দেহো নায়কে বাবা, দুয়ো কারাম ডৗর।

অর্থাৎ পুরোহিত ঠাকুর, একলতি সুতো এনে করম ডাল দুটোকে একত্রে বেঁধে দাও। এবার করম ঠাকুরকে করম থানে প্রতিষ্ঠা করার পর কারমাটি কুড়ি’র (যারা জাওয়া পাতে, সাঁওতালিতে তারা হল কারমাটি কুড়ি) তিন চারজন জাওয়াকে কোলে করে করম থানে নিয়ে আসে। ওখানে তিনবার থানের চারদিকে ঘোরে নির্দিষ্ট থান বা বেদিতে নামিয়ে রাখে। এরপর কারমাটি মেয়েরা যে যার বাড়ি চলে যায়। কিছুক্ষণ পরে সেজেগুজে করম থানে ফিরে আসে। মাথায় থাকে বাঁশ দিয়ে তৈরি এক ধরণের ডালা বা ঝুড়ি। ডালায় মুখ ঢেকে তার মধ্যে প্রদীপ জ্বলে। উল্লেখ্য,কচু পাতায় ডালার মুখ ঢেকে তার মধ্যে প্রদীপ জ্বালিয়ে দেয়। জ্বালাবার সময় বোন ভাইয়ের মঙ্গল কামনা করে,করম ঠাকুরের কাছে পার্থনা জানায়। তারা গান গায় – 

জালি দে ভাই জালি দে রশমের বাতি

সে হো বাতি জ্বলে আঁধারে। (২)

কে লাগাঞ দিল রে বাতি

ভায়া লাগাঞ দিল রে বাতি

সে হো বাতি জ্বলে আঁধারে। (২)

এবার প্রদীপ জ্বালানো ডালা সমেত করম থানের চতুর্দিকে গোল করে দাঁড়িয়ে যায়। ডালা ধরা থাকে বাঁ হাতে ঠিক কনুই বরাবর, মাথায় থাকে ঘটির জল। দেখতে অপূর্ব। ধামসা-মাদলের দ্রিমি দ্রিমি আওয়াজ শুরু। খানিকদূরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। ধামসা-মাদলের তালে নাচ-গান। খানিক এগিয়ে, খানিক পিছিয়ে। এর উদ্দেশ্যে করম ঠাকুরকে চুমো দেওয়া। সে সময়ের একটি গান। 

তাঁহা রেতা নানা তারনা তাঁহা রেতা নানা হো

চুমাই দেগো চুমাই দে, দুয়ো কারাম ডৗর যায়ো

দেগো যায়ো চুমাই দে, দুয়ো কামার ডৗর।

অর্থাৎ চুমু দাও মাগো, করম ডাল দুটিকে চুমু দাও। 

এভাবে সাতপাক দেওয়ার পর যে যার নিজের ডালা সামনে রেখে মেয়েরা অর্ধচন্দ্রাকার ভাবে বসে পড়ে। গ্রামের সর্বসাধারণ, ভদ্রমন্ডলী, আবাল বৃদ্ধবনিতা করম আখড়ায় সমবেত হয়। করমগুরু সাঁওতাল সৃষ্টিতত্ত্ব থেকে বিস্তি বা উপাখ্যান বলতে শুরু করেন। বিভিন্ন পুঙ্খানুপুষ্প বর্ণনা দিতে গেলে রামায়ণ- মহাভারত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সুতরাং সংক্ষেপে বলতে গেলে যার অর্থ দাঁড়ায় তা হল- সাঁওতাল সমাজ কী করে সৃষ্টি হল? তাদের আদি মানব কে? করম পুজো কবে থেকে এবং কেন করা হয় ইত্যাদি। বিস্তি সারারাধ ধরে চলে। পরের দিন অর্থাৎ দ্বাদশীর দিন মেয়েদের খুব একটা কাজ থাকে না। সারারাত ধরে বিত্তি শোনার পর সকাল সকাল স্নান করে সেজেগুজে পরিপাটি হয়ে ঘুরে বেড়ায়। নিজেদের মধ্যে হাসিঠাট্টা করে বেশ কয়েক দিন ব্রত করার ফলে এদিন তারা সাধ্যমত ভালমন্দ খাবার খায়। এদিন পুরুষদের একটু কাজ থাকে। সকাল সকাল বন থেকে শাল গাছের ছাল, শিরহি ডাল, ভেলা ডাল কেটে এনে নিজ নিজ ধান ক্ষেতে পুঁতে দেয়। বেলা বাড়ার সাথে সাথে ছেলে বা পুরুষদের মধ্যে কেমন একটা উন্মাদনা, চনমনে ভাব শুরু হয়। মাঝির বাড়ির সামনে করম গাছের পাশে যেখানে সারারাত ধরে বিত্তি হল, সেখানে ডুডুং ডুডুং করে বাজনার আওয়াজ শুরু হয়। অর্থাৎ সবাইকে আহ্বান করা হচ্ছে নাচার জন্য। চতুর্দিকে হৈ-হুল্লোড় পড়ে যায়। আস্তে আস্তে আশপাশের গ্রামের থেকেও নৃত্যদল আসে। মাথার দুপাশে ময়ূরের পালক দিয়ে আঁটোসাঁটো বেঁধে হাতে হলুদ-সবুজ বিভিন্ন রঙের রুমাল পায়ে নুপূর এবং ফুরুৎ ফুরুৎ করে বাঁশি বাজিয়ে নাচ গান শুরু হয়। বিভিন্ন রকমের অঙ্গভঙ্গি করে পুরুষদল নাচে। আস্তে আস্তে যখন দলভারী হয় নাচ গানের উন্মাদনা আরও বেড়ে ওঠে, কোন ক্লান্তির ছাপ চোখে দেখা যায় না। তারই ফাঁকে হাঁড়িয়ার রসে তারা ভেসে বেড়ায় স্বর্গরাজ্যে।

বেলা ডুডুডুবু, এবার করম দেবতাকে বিদায় দেবার পালা। মেয়েদের দল এবারের মতো করম দেবতাকে চুমু দেওয়ার জন্য তৈরি হয়। সবার চোখে  মুখে ফুটে ওঠে বিদায়ের ব্যথা। বেজে ওঠে বিরাগের সুর। ধামসা মাদলের সুর পাল্টে যায়। মেয়েদের একজন জাওয়া মাথায় নেয়। একজন মাচি (চৈকি) এবং দুজন দুটো করম ডাল হাতে নিযে দু-তিন আখড়া নাচ-গান করে চলে যায় পুকুর বিসর্জন দিতে। যায় গান গাইতে গাইতে। বিসর্জন দেওয়ার ফাঁকে চাঁদ ওঠে। ধরিত্রীর বুকে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ে। পুরুষদের দল সমান তালে নেচে চলে। বিসর্জন দিয়ে মেয়েদের দলও পুনরায় একে অপরের হাত ধরাধরি করে নাচ-গানে সামিল হয়। তখন ‘লাঁগড়ে’ নাচ শুরু হয়। ঘন্টার পর ঘন্টা কোথা দিয়ে যে উড়ে চলে যায়। তা ভাবা যায় না।

এখানে একটা বিষয় লক্ষনীয় যে, সাঁওতালদের করম উৎসবের মেয়েরা শশা-কে সন্তান বলে মনে করে এবং ধান গাছকে ক্ষেত থেকে তুলে আবার ক্ষেতের মধ্যেই বসিয়ে দেওয়া এসবের মধ্যে শস্যোৎসবের তাগিদ লক্ষ্য করা যায়। যাই হোক, করম উৎসবের মধ্যে কৃষিজীবি মানুষের এক উজ্জ্বল চিত্র পরিলক্ষিত হয়।

                 

Santali dasay /দাঁশায় চেদাঃ বন দাড়ান আ ?
Santali dasay /দাঁশায় চেদাঃ বন দাড়ান আ ?
Santali dasay /দাঁশায় চেদাঃ বন দাড়ান আ ?
Santali dasay /দাঁশায় চেদাঃ বন দাড়ান আ ?
Santali dasay /দাঁশায় চেদাঃ বন দাড়ান আ ?
Santali dasay /দাঁশায় চেদাঃ বন দাড়ান আ ?